দুনিয়া ও আখিরাতে ধর্ষণের কঠোর শাস্তি নির্ধারিত। ইসলামি আইনশাস্ত্রে ধর্ষকের শাস্তি ব্যভিচারকারীর শাস্তির অনুরূপ। তবে অনেক ফেকাহবিদ ধর্ষণের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কিছু শাস্তির কথা উল্লেখ করেছেন। আবার শাস্তির ক্ষেত্রে ধর্ষিতাকে নির্দোষ ঘোষণা করে ইসলাম। কেননা, ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার ওপর বলপ্রয়োগ করা হয়েছে।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে নবী (স.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার উম্মতের ভুলবশত করা অপরাধ, ভুলে যাওয়া কাজ ও বলপ্রয়োগকৃত বিষয় ক্ষমা করে দিয়েছেন।’ (ইবনে মাজাহ: ২০৪৫)
ধর্ষণ কেমন অপরাধ
ধর্ষক একইসঙ্গে দুটি অপরাধ করে। ১) ব্যভিচার ২) বলপ্রয়োগ বা ভীতি প্রদর্শন। ব্যভিচারের শাস্তি হচ্ছে-অবিবাহিতকে ১০০ বেত্রাঘাত। বিবাহিতকে মৃত্যুদণ্ড।
ধর্ষণের শাস্তি বিষয়ে ইসলামি আইনজ্ঞদের বিভিন্ন মত রয়েছে। ইমাম আবু হানিফা, শাফেয়ি ও আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ)-এর মত হলো- ‘ধর্ষণের জন্য ব্যভিচারের শাস্তি প্রযোজ্য হবে।’ অর্থাৎ ধর্ষক অবিবাহিত হলে ১০০ বেত্রাঘাত আর বিবাহিত হলে পাথর মেরে মৃত্যু নিশ্চিত করা।
ইমাম মালেক (রহ)-এর মতে, ‘ধর্ষণের অপরাধে ব্যভিচারের শাস্তি প্রয়োগের পাশাপাশি ‘মুহারাবা’র শাস্তিও প্রয়োগ করতে হবে।
মুহারাবার শাস্তি কী?
অস্ত্র দেখিয়ে বা অস্ত্র ছাড়াই ভীতি প্রদর্শন করে ডাকাতি করা কিংবা লুণ্ঠন করার যে শাস্তি, সেই শাস্তিকে মুহারাবার শাস্তি বলে। এই শাস্তি সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়া বা হত্যা করা উভয়টিই হতে পারে। মুহারাবার শাস্তি হিসেবে আল্লাহ ঘোষণা করেন—
‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সাথে সংগ্রাম করে এবং দেশে হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাস্তি হচ্ছে এই যে- তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলীতে চড়ানো হবে অথবা তাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে (ডান হাত বাম পা/বাম হাত ডান পা) কেটে দেয়া হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার তথা নির্বাসিত করা হবে। ‘এটি হল তাদের জন্য দুনিয়ার লাঞ্ছনা আর পরকালে তাদের জন্যে রয়েছে কঠোর শাস্তি।’ (সুরা মায়েদা: ৩৩)
এ আয়াতের আলোকে বিচারক ধর্ষণকারীকে ব্যভিচারের শাস্তির সঙ্গে সঙ্গে উল্লেখিত চার ধরণের যে কোনো শাস্তি প্রয়োগ করতে পারবে। কেননা ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য ধর্ষণ হলো আল্লাহ ও তার রাসুলের নিয়ম-নীতি বিরুদ্ধ অপরাধ। আর তা তাদের সঙ্গে যুদ্ধে উপনীত হওয়ার শামিল। তাছাড়া ধর্ষণের ক্ষেত্রে বল প্রয়োগ করা হয়। ইসলামের বিধান লঙ্ঘনে বল প্রয়োগ করলেও এ শাস্তি প্রযোজ্য হবে।
তাই সমাজে যখন ধর্ষণ মহামারী আকার ধারণ করে তখন সমাজ থেকে ধর্ষণ সমূলে উৎপাটন করতে (মুহারাবার) মতো ভয়াবহ শাস্তি প্রয়োগ করাও জরুরি। আর যদি ধর্ষণ কারণে হত্যাজনিত অপরাধ সংঘটিত হয় কিংবা ধর্ষণের শিকার কোনো ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে তবে ঘাতকের শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড।
অনেকে মৃত্যুদণ্ডের বিকল্প হিসেবে অর্থদণ্ডের কথাও বলেছেন। অর্থদণ্ডের পরিমাণ হচ্ছে, একশ উটের সমমূল্য অর্থ। তাদের মতে, ধর্ষণের সঙ্গে যদি আরও কোনো অপরাধ ঘটে— যেমন অশ্লীল ভিডিও ধারণ করা ও ওই ধরনের ভিডিও প্রচার করা ইত্যাদি অপরাধ পাওয়া গেলে, তার দণ্ডের পরিমাণ আরও বেশি হবে।
পরকালে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি ছাড়াও দুনিয়ায় দারিদ্র ও অকালমৃত্যুর মতো আজাব দেওয়া হয় ব্যভিচারীকে। বলা হয়েছে, ‘ব্যভিচারের মন্দ পরিণাম ছয়টি। তিনটি দুনিয়ায় আর তিনটি আখেরাতে। দুনিয়ার তিনটি হলো— ১) চেহারার সৌন্দর্য নষ্ট হওয়া। ২) দরিদ্র। ৩) অকালমৃত্যু। আর আখেরাতের তিনটি হলো- ১) আল্লাহর অসন্তুষ্টি, ২) হিসাব-নিকাশে কঠোরতা। ৩) জাহান্নামের কঠিন শাস্তি। (ইসলামের দৃষ্টিতে অপরাধ, ই. ফা. পৃষ্ঠা-১০৯)
ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির শাস্তি নেই
হাদিসে এসেছে, রাসুল (স.)-এর যুগে এক নারীকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করা হলে রাসুল (স.) ওই নারীকে কোনোরূপ শাস্তি দেননি, তবে ধর্ষককে হদের শাস্তি দেন। (ইবনে মাজাহ: ২৫৯৮) ‘হদ’ মানে- যে শাস্তির পরিমাণ ও পদ্ধতি কোরআন-হাদিসে সুনির্ধারিত।
ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির করণীয়
কেউ ধর্ষণের শিকার হতে যাচ্ছেন, এমন অবস্থায় তার করণীয় হলো, তা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করা। এমনকি যদিও নিজের সম্ভ্রম রক্ষায় ধর্ষণকারীকে হত্যা করার মতো কিছু হয়, তাতেও ইসলাম সায় দিয়েছে। সম্ভ্রম রক্ষার চেষ্টা করতে গিয়ে কারো মৃত্যু হলে তিনি শহীদি মর্যাদা লাভ করবেন।
সাইদ ইবনে জায়েদ (রা.) বলেন, আমি রাসুল (স.)-কে বলতে শুনেছি, ‘সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে যে ব্যক্তি নিহত হয়েছে, সে শহীদ। জীবন রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সেও শহীদ। দীন রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সে শহীদ। আর সম্ভ্রম রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সেও শহীদ।’ (আবু দাউদ: ৪৭৭২, তিরমিজি: ১৪২১)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে ধর্ষণের মতো কঠিন গুনাহ থেকে বিরত থাকার তাওফিক দিন। সুন্নাহ অনুযায়ী ধর্ষকের শাস্তি কার্যকর করার তাওফিক দান করুন। আমিন।